আমার ফেইসবুক নিউজফিডে মাঝে মধ্যে Wasfia Nazreen এর বিভিন্ন পোস্ট আসে। উনি এবং নিশাত মজুমদার প্রথম দুই বাংলাদেশি এভারেস্ট জয়ী নারী। মোটামুটি একই সময়ে তারা এভারেস্টে ওঠেন। বাংলাদেশী মেয়ে এভারেস্টের চূড়ায় উঠবে আমরা বেঁচে থাকতে, কেন জানি এটা কোনদিন ভাবিনি। একবার ৫-৭ দিনের জন্য ট্রেকিং করতে গিয়েছিলাম কেওকারাডং এবং তাজিনডং এর দিকে। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল। বলা যায়, সেটা ছিল আমার জীবনের একমাত্র রিস্কি এডভেঞ্চার। একটা গোপন ইচ্ছা জেগেছিল, যদি কোনদিন হিমালয়ের বেইস-ক্যাম্পে যাওয়া যেত! যাইহোক, একদিন সকালে নিউজে নাজরিন এবং নিশাতের এই খবর দেখে আমার বেইস-ক্যাম্পে কোনদিন যেতে না পারার গোপন কষ্টটা হালকা হয়ে গেল। ওয়াসফিয়া আরো কঠিন পর্বত-চূড়ায় ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ফেইসবুকে নিয়মিত আপডেট আসে, দেখে একধরনের ব্যক্তিগত জয়ের আনন্দ পাই। উনাদের জন্য অভিবাদন এবং শুভকামনা থাকল।

একদিন উদ্ভট একটা চিন্তা মাথায় এল। ওয়াসফিয়া নাজরিনের সাথে তুলনা করলে আমার নানীর জীবনের অর্জনগুলো কি? তুলনাটা একটু সহজ কারণ আমার নানী মারা গেছেন কিছুদিন আগে, এভারেস্টে উঠে নাজরিনের সাথে পাল্লা দেয়ার সুযোগ তার আর নেই। নানীর স্মৃতি বলতে আমার শুধু রান্না-বান্না আর খাওয়া-দাওয়ার কথা মনে আসে। আমার মামা-খালারা অনেকেই বছর শেষে বাচ্চাদের স্কুল ছুটি হলে হাজির হতেন সারাদেশ থেকে। আমরা ছোটবেলায় পুরো বছর জুড়ে অপেক্ষা করতাম সেই সময়ের জন্য। আমার নানী একাই তিরিশ-চল্লিশজনের রান্না করতেন একসাথে। উনি নাতি-নাত্নিদের জন্য এখানে সেখানে খাবার লুকিয়ে রাখতেন - যে নাতি মিষ্টি পছন্দ করে তার জন্য মিষ্টি, যে আম খেতে পছন্দ করে তার জন্য আম। জীবনে প্রথমবার আমি বড়শী দিয়ে মাছ ধরেছি। ছোট একটা মাছ - টেংরা কি শিং ঠিক মনে নেই। সবাই বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে যেন আমি বিশ্বজয় করে এসেছি। এদিকে আমি টেনশনে আছি, একটা মাত্র মাছ অথচ এতগুলো মানুষ! নানী সমস্যার সমাধান করলেন আস্ত মাছটাই আমার প্লেটে তুলে দিয়ে। রাতে ঘুমানোর আগে উনি আমাদের গল্প শুনাতেন। ভূতের গল্পই বেশী বলতেন। কখনো সখনো ছড়া। উনি ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল খুব ছোটবেলায়। আবার পুরনো প্রশ্নে ফিরে আসি, উনার জীবনের অর্জনগুলো কি? সত্যি বলতে, আমি ঠিক জানিনা। আমার শুধু মনে পড়ে বড় হবার পরে শেষ যে ক'বার দেশের বাড়িতে গেছি প্রতিবার উনি নানাকে বাজারে পাঠিয়েছেন আমার জন্য বাতাসা কিনে আনতে। উনি হয়তো মেনে নিতে চাননি আমি বড় হয়ে গেছি, আমি আর বাতাসা খেতে পছন্দ করিনা। আমি জানিনা উনি কখনো হিমালয়ের নাম শুনেছেন কিনা, তবে উনার জীবন আমার চোখে এভারেস্টের বেইস-ক্যাম্পে যাওয়ার মতই আনন্দের ব্যাপার বলে মনে হয়।

কেউ আবার ভেবে বসবেন না আমার পরিচিত অপরিচিত সব বাঙ্গালী নারীকেই আমি কোন না কোন ভাবে হিমালয়ে পাঠাচ্ছি। অবশ্য, বাংলাদেশে মেয়ে হয়ে বড় হওয়াটাই একটা ছোটখাট এডভেঞ্চার। ক্লাশ ফাইভে পড়ি তখন, আমাদের সাথে এক মেয়ে ফুটবল খেলতে আসে। সে একদিন আচমকা আসা বন্ধ করে দিল - বড় হয়ে গেছে, এই বয়সে আর ছেলেদের সাথে খেলা যাবেনা। এরপর অসংখ্য মেয়েকে দেখেছি, পড়াশোনা করছে ভালো বিয়ের জন্য। ঘর-সংসার করবে, ছেলে-মেয়ে মানুষ করবে, স্বামী-সেবা করে জীবন পার করে দেবে। হয়তো চাকরির বাজার ভাল না হওয়াটা এর পিছনে অন্যতম কারণ, হয়তো ব্যক্তিগত রুচিটাই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু এটাও সত্য যে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্টি করা ফানেলে জীবনের আকার-আকৃতি ঠিক হয়ে যাচ্ছে বেশীরভাগ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ের। মড়ার উপরে খাড়ার ঘার মতো আবার আছে আমাদের হুজুরগোষ্ঠী, মেয়েরা যাদের চোখে উর্বর শস্যক্ষেত্র ছাড়া আর কিছুই না। নিম্নবিত্তদের কথাতে আর নাইবা গেলাম - বেঁচে থাকাটাই তাদের জন্য বেশীরভাগ সময় অভিশাপ।

প্রতিটি বাঙ্গালী নারী, যে নারী হওয়ার আগে একজন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দেখে, যে মেনে নেয়না চাপিয়ে দেয়া নিয়ম, যে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেয় তার জীবন, সে অলরেডি এভারেস্টের কোন না কোন লেভেলে উঠে গেছে। তাদের সবার জন্য অভিবাদন এবং শুভকামনা।
0

Add a comment

About Me
About Me
My Photo
When I was a kid my grandparents used to tell me stories about fictional kings, queens and their kingdoms. It took me some time to realize that, despite not being a king or a prince, we all have our own stories to tell.
Books I'm Reading
Blog Archive
Loading
Dynamic Views theme. Powered by Blogger. Report Abuse.